আচ্ছা, সহজ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক, একজন স্ট্রাইকারের কাজ কী? সহজ উত্তর- গোল করা। কিন্তু ট্যাকটিক্যাল বিপ্লবের এই যুগে স্ট্রাইকারের কাজ শুধু গোল করা বলাটা বেশ ভয়ংকর ভুলই বলা চলে। বর্তমানে কোচরা বেশ ‘ডিমান্ডিং’, শুধু গোল দিয়ে তাদের কাজ চলে না। আর এই কথাতেই চলে আসে স্ট্রাইকারদের অন্যতম এক পরিবর্ধিত রূপের কথা, যার নাম ‘ফলস নাইন’ আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই ফলস নাইন, যে ভূমিকায় খেলে ডিফেন্ডারদের রীতিমতো তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছেড়েছিলেন লিওনেল মেসি।
‘ফলস নাইন’ কী
‘ফলস’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ মিথ্যা, আর নয় নম্বর সংখ্যাটি দিয়ে সাধারণত বোঝানো হয় দলের স্ট্রাইকারকে। ‘ফলস নাইন’ শব্দযুগলটির আক্ষরিক অর্থ তাই দাঁড়ায় মিথ্যা স্ট্রাইকার। এরকম নামকরণের কারণ কী?
ফুটবল মাঠকে সাধারণত উল্লম্বভাবে তিন ভাগে এবং অনুভূমিকভাবে ছয় ভাগে, সব মিলিয়ে আঠারো ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত একজন স্ট্রাইকার খেলেন প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে, যেটা হলো জোন নম্বর সতেরো।
(ছবিঃ- ফুটবল মাঠের কৌশলগত ভাবে ১৮টি জোনে ভাগ করা হয়েছে)
আঠারোটি জোনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল জোন হিসেবে ধরা হয় জোন নম্বর চৌদ্দকে। এখানে মূলত খেলেন দলের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়েরা, অর্থাৎ প্লে-মেকাররা। এখান থেকেই মূলত এই ‘নাম্বার টেন’ বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডাররা কোনো দলের আক্রমণের কিলার পাস বাড়ান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফলস নাইন কী করেন?
আগেই বলা হয়েছে, স্ট্রাইকারদের মূলত তাদের খেলা খেলেন নিজের বক্সে। একটু নিচে এসে হয়ত খেলায় আরেকটু বেশি অংশ নেন, কিন্তু তারা কখনোই দলের মূল প্লেমেকার বা মূল প্লেমেকারদের একজন হন না। এই জায়গায়ই সাধারণ নাম্বার নাইনের সাথে ফলস নাইনের পার্থক্য।
‘ফলস নাইন’ পজিশনে খেলা খেলোয়াড় সাধারণত ম্যাচের শুরুতে থাকেন নাম্বার নাইনের পজিশনেই। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে, তারা জোন সতেরো থেকে নিচে নেমে আসেন জোন চৌদ্দতে, সেখান থেকে প্লেমেকারের মতো কাজ করেন। অর্থাৎ সহজ কথায়, স্ট্রাইকার বনে যান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। প্রশ্ন আবারো আসে, কেন? স্ট্রাইকারের এরকম মিডফিল্ডার বনে যাওয়ার দরকার কী? বলা যায়, অনেক দরকার।
সাধারণত রক্ষণের সময় প্রতিপক্ষ আর নিজের গোলের মাঝখানে সব দলই ডিফেন্ডারদের দুটি সারি তৈরি করে থাকেন। চারজনের রক্ষণের ফর্মেশনে সাধারণত সারি দুটি হয় চারজনের, কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে দেখা যায় পেছনের সারিটি চার ও সামনের সারিটি পাঁচজনের হয়। অন্যদিকে তিনজনের রক্ষণের ফর্মেশনে দুটি সারির পেছনেরটি সাধারণত হয় পাঁচজনের, সামনেরটি চারজনের। তবে কিছু অতিরক্ষণাত্মক কোচ দুটি পাঁচজনের সারি তৈরি করেন, অর্থাৎ সব আউটফিল্ড খেলোয়াড়কেই সাধারণত ব্যবহার করা হয় ডিফেন্ডিংয়ের কাজে। সে কথা অন্যভাবে বলা যাবে, আমরা এখন বলছি ফলস নাইন কীভাবে কাজ করেন তার কথা। রক্ষণে দুটি সারি তৈরি করার পর দেখা যায় দুটি সারির মাঝখানে অনুভূমিক একটি ফাঁকা স্পেস থাকে, সেখানে মূলত নাম্বার টেন বা এটাকিং মিডফিল্ডার খেলা তৈরি করেন। কিন্তু, অধিকাংশ দলই বর্তমানে প্লেমেকার ব্যবহার করা ৪-২-৩-১ ফর্মেশনের চেয়ে ৪-৩-৩ বা ৪-৪-২ ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, এই স্পেস ব্যবহার করার মতো খেলোয়াড় দলে থাকে। মিডফিল্ড থেকে কাউকে এখানে ব্যবহার করলে মাঝমাঠে দল নিউমেরিকালি আউটনাম্বার হয়, কোনো উইঙ্গারকে ব্যবহার করলে কোনো একটি উইং ফাঁকা হয়ে যায়। এসব ঝামেলা এড়িয়ে যাবার জন্যই ব্যবহৃত হয় ফলস নাইন।
(ছবিঃ- ফলস নাইন)
ফলস শব্দটার আরেকটি অর্থ ধোঁকা, ফলস নাইনকেও ধোঁকাবাজ স্ট্রাইকার বলা যায়। সাধারণত একজন স্ট্রাইকারের পজিশন হয় প্রতিপক্ষের দুই সেন্টার ব্যাকের মাঝখানে, যেকোনো একজন কিংবা কিছু কিছু সময় দুজন মিলেই মার্ক করে তাকে। অন্যদিকে, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে সাধারণত যেকোনো একজন সিবি অথবা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মার্ক করে। সুতরাং, যখন একজন স্ট্রাইকার ফলস নাইন হিসেবে খেলেন, বেশ ঝামেলায় পড়ে যান বিপক্ষ সেন্টার ব্যাক এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। কারণ, যদি তাকে মার্ক করতে থাকা সেন্টারব্যাক তার সাথে এগিয়ে আসেন, তাহলে পেছনে থাকবে অগাধ জায়গা।
আবার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার যদি নিচে নেমে এসে ফলস নাইনকে মার্ক করেন, মিডফিল্ডে আউটনাম্বার হয়ে যাবে দল। ঝামেলা, তাই না?ফলস নাইনের সুবিধা এখানেই, ফলস নাইন নিজের স্ট্রাইকার পজিশন ছেড়ে আসায় জোন সতেরো থাকে খালি। ফলে সেখানে আক্রমণ করতে থাকা দলের যেকোনো খেলোয়াড় গিয়ে ফিনিশিং টাচ দিতে পারেন, সহজ কথায় সেই জায়গাটুকু ব্যবহার করতে পারেন এবং নিজের মার্কারকে আউট অফ পজিশন করে ঝামেলা তৈরি করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের পুরো ডিফেন্সিভ শেইপেই। ফলস নাইন থেকে পাওয়া আরেকটি সুবিধা হচ্ছে- মিডফিল্ডে খেলোয়াড় পাওয়া যায় একজন বেশি, যার ফলে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করা সহজ হয়। আর আধুনিক ফুটবলে, মাঝমাঠ যার, খেলাটা তারই। ফলস নাইনকে আটকানোর উপায় যে নেই, তা অবশ্য নয়। সাধারণত মিডফিল্ডে ডাবল পিভট অর্থাৎ দুজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার খেলিয়ে ফলস নাইনকে আটকানো যায়।
মূলত ফলস নাইনের সফলতা হচ্ছে, যখন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারেরা কনফিউজড হয়ে পড়বে, এর সুযোগ নিয়েই ফলস নাইন নিজে গোল করবে অথবা কাউকে দিয়ে গোল করিয়ে স্কোরলাইন নিজেদের পক্ষে ভারী করবে । মূলত এই রোলটি হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ ফ্রি রোল। দলের ট্যাকনিকেলি সবচেয়ে বেশি সামর্থ্যবান প্লেয়ারটিকে কোচ চুজ করেন এমন রোলে খেলানোর জন্য। ২০১২ তে পেপের মেসি , দেল বস্কের ফ্যাব্রেগাস ২০০০ পরবর্তী সময়ে এই রোলে সফলতার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যাইহোক, শেষ করার আগে মেসির প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ফলস নাইন রোলের সর্বোচ্চ সফলতাই মেসির ২০১২ এর অবিশ্বাস্য ঐ রেকর্ডকে সঙ্গায়িত করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, যার পেছনে তৎকালীন বার্সা কোচ পেপ গার্দিওলার অবদান অনস্বীকার্য।
যুগে যুগে ফলস নাইন
অনেকেই মনে করেন, ফলস নাইন বেশ নতুন ধারণা। ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়, ফলস নাইন বেশ পুরনো বিষয়। প্রথম ফলস নাইন দেখা যায় ত্রিশের দশকের বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান ‘ওয়ান্ডারটিম’ এ। সেই দলে ফলস নাইন হিসেবে খেলেছিলেন ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার। তবে প্রথম বিখ্যাত ফলস নাইনের নাম হিদেকুটি, নান্দর হিদেকুটি।
(ছবিঃ- হিদেকুটি; সামনে পুসকাস)
হিদেকুটি ছিলেন পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত হাঙ্গেরি দল ‘ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স’ এর স্ট্রাইকার, আদতে ফলস নাইন। তিনি ফলস নাইনে খেলে যে স্পেস তৈরি করতেন, সেটি ব্যবহার করতেন ফেরেঙ্ক পুসকাস ও স্যান্ডর ককসিস। তারা তিনজন মিলে তৈরি করেছিলেন ভয়ংকর এক ত্রয়ী, যারা মাঠে নামতো প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে। কালের প্রবাহে অবশ্য পুসকাস কিংবা ককসিসের চেয়ে খ্যাতি কম পেয়েছেন হিদেকুটি, কিন্তু সেই দলে তার অবদান ছিলো অনস্বীকার্য। ষাট ও সত্তরের দশকের বিখ্যাত আয়াক্স ও নেদারল্যান্ডস দলে বেশ কয়েকবার ফলস নাইন হিসেবে খেলেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রুইফ, তবে সেটি তার স্থায়ী পজিশন ছিলো না।
এরপর ফলস নাইন পজিশনটির ব্যবহারে ভাটা পড়ে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০০৬-০৭ সিজনে রোমায় লুসিয়ানো স্প্যালেত্তির অধীনে ফ্রান্সেসকো টট্টির মধ্য দিয়ে পুনরায় জীবন লাভ করে ফলস নাইন। ফুটবল বিশ্বের অধিকাংশ দলই তখন ৪-৪-২, কিংবা ৪-৩-৩ কিংবা খুব বেশী হলে ৪-২-৩-১ ফর্মেশানে খেলে। লুসিয়ানো স্প্যালেত্তির রোমাও তখন খেলত ৪-২-৩-১ ফর্মেশানে। সামনের একক ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলার দায়িত্ব ছিল মিশরীয় স্ট্রাইকার মিডো, নাহয় ইতালিয়ান স্ট্রাইকার ভিনসেঞ্জো মন্তেয়া, আরেক ইতালিয়ান স্ট্রাইকার ফ্র্যানসেস্কো তাভানো – এদের মধ্যে যেকোন একজনের।
(ছবিঃ- ফ্র্যানসেস্কো টট্টি)
আর কিংবদন্তী ফ্র্যানসেস্কো টট্টি খেলতেন ঠিক সেই একক স্ট্রাইকারের পেছনে, ”ট্রেকোয়ার্টিস্টা” কিংবা সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধল যখন স্প্যালেত্তির প্রত্যেকটা স্ট্রাইকারই একসাথে ইনজুরিতে পড়ল তখন। মিডো, মন্তেলা, ওকাকা- সবাই-ই ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে। কি হবে এখন? এই বড় ঝামেলার সময়ে স্প্যালেত্তিকে উদ্ধার করলো তাঁর তুখোড় ফুটবল মস্তিষ্ক। তিনি জানতেন তাঁর হাতে রয়েছে ইতালিয়ান ফুটবলের রাজপুত্র ফ্র্যানসেস্কো টট্টির মত একজন খেলোয়াড়। টট্টিকে বললেন সেই একক স্ট্রাইকারের ভূমিকায় খেলতে। কিন্তু স্কোয়াডের অন্যান্য স্ট্রাইকাররা যেভাবে খেলতেন, ঠিক সেভাবে না। টট্টি তাঁর স্বভাবজাত ট্রেকোয়ার্টিস্টা হিসেবেই খেলবেন মূলত, কিন্তু তাঁর সামনে আর অন্য কোণ স্ট্রাইকার থাকবেনা এই ফর্মেশানে। টট্টিই হবেন দলের আক্রমণের মূল ফোকাস। স্ট্রাইকার বা আদর্শ ”নাম্বার নাইন” এর জায়গাতে খেলেও টট্টি ঠিক ”নাম্বার নাইন” হিসেবে খেলবেন না।
একজন আদর্শ নাম্বার নাইনের বা সেন্টার ফরোয়ার্ডের মত ডিবক্সের মধ্যে বসে না থেকে অন্য অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের সহায়তার জন্য অপেক্ষা না করে তাঁর ভূমিকাটা হবে ট্রেকোয়ার্টিস্টারই, অর্থাৎ নিচে নেমে তাঁকে যথারীতি প্লেমেকিং এর কাজটা করতে হবে, তাঁর অবস্থানটা হবে প্রতিপক্ষের সেন্ট্রাল ডিফেন্স ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডের মাঝে। এই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করার জন্য স্প্যালেত্তি নিজের ৪-২-৩-১ ফর্মেশানকে বদলালেন না। বরং একটু উন্নত করলেন। তাঁর নতুন এই ফর্মেশানটা হল অনেকটা ৪-৬-০ বা আরেকটূ স্পষ্ট করে বললে, ৪-৫-১-০ এর মত। উপরে প্রথাগত কোন টার্গেটম্যান থাকবেন না, টট্টি খেলবেন তাঁর স্বভাবত সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেই, কিন্তু ভূমিকা পালন করবেন একজন আদর্শ সেন্টার ফরোয়ার্ডের মত আক্রমণের মূল ফোকাস পয়েন্ট হিসেবে। নিচে পাঁচজন মিডফিল্ডারের মধ্যে মন্টিনিগ্রিয়ান খেলোয়াড় মির্কো ভুচিনিচ খেলবেন বাম মিডফিল্ডার ও ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার মানচিনি খেলবেন ডান মিডফিল্ডার হিসেবে, পেছনে তিনজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের ভূনিকায় থাকবেন চিলিয়ান সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার ডেভিড পিজারো, আর দুই ইতালিয়ান সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সিমোনে পেরোত্তা ও ড্যানিয়েলে ডি রসি। পিজারো আর ডি রসি থাকবেন একটু পেছনে, ডিফেন্সের সামনে, তাদের সামনে হবে সিমোনে পেরোত্তার অবস্থান, এমনভাবে পেরোত্তার অবস্থানটা হবে যেন সেটা ফ্র্যানসেস্কো টট্টির ট্রেকোয়ার্টিস্টা অবস্থানের সাথে সংঘর্ষ না ঘটায়।
এই অসাধারণ আবিষ্কারের ফলে প্রতিপক্ষের যে সমস্যা হল, সেটা হল রোমার কোন প্রথাগত টার্গেটম্যান বা সেন্টার ফরোয়ার্ড না থাকার কারণে প্রতিপক্ষের দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডাররা মার্ক করার মত কাউকে পেলেন না, কারণ টট্টি খেলছেন প্রথাগত টার্গেটম্যানের অবস্থানের থেকে একটু পেছনে, ফলে টট্টিকে মার্ক করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারদের নিজেদের ডিফেন্স লাইন থেকে উঠে এসে মার্ক করতে হত, আবার মিডফিল্ডে টট্টি ছাড়াও আরও পাঁচজন থাকার ফলে (যাদের মধ্যে দুইজন আবার উইঙ্গার হিসেবে দুই সাইডে খেলছেন) প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডাররাও এক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের সেন্ট্রাল ডিফেন্সকে সহায়তা করতে পারতেন না। ফলে প্রত্যেক ম্যাচেই রোমার বল দখলের হারটা প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশী হতে থাকলো, রোমা হয়ে উঠলো আরও আক্রমণাত্মক। মূলত স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা মির্কো ভুচিনিচকে এই ফর্মেশানে স্প্যালেত্তি লেফট উইঙ্গার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলেন, যাতে উইং থেকেও গোল আসে। টট্টি নিচে নেমে খেলার কারণে টট্টি দ্বারা যতটুকু জায়গা উপরে ফাঁকা হচ্ছিল, সেটা পূরণ করার জন্য দুইপাশ থেকে দুই উইঙ্গার ক্রমাগত উপরে চলে যেত।
রোমা স্কোয়াডে টট্টি আর ড্যানিয়েলে ডি রসি ছাড়া সেরকম কেউই বিশ্বমানের না হবার কারণে এই অসাধারণ আবিষ্কারটা দিয়েও রোমা বেশী ট্রফি জিততে পারেনি, শুধু জিতেছিল একটি সুপারকোপা ইতালিয়ানা আর একটু কোপা ইতালিয়া। কোপা ইতালিয়া ফাইনালের দুই লেগে তৎকালীন লিগ চ্যাম্পিয়ন ইন্টার মিলানকে দুই লেগ মিলিয়ে ৭-৩ গোলে হারিয়ে লুসিয়ানো স্প্যালেত্তি প্রমাণ করেন তাঁর এই আবিষ্কারটা ‘ফ্লুক’ ছিল না কিছু, কিন্তু নিয়মিত সফলতা পাননি তিনি এই ফর্মেশানে, কেননা দুর্ভাগ্যবশতঃ, যেটা বললাম, তাঁর হাতে সেরকম বিশ্বমানের স্কোয়াড ছিলনা।
টট্টির অবস্থানের জন্য এই ফর্মেশানের নামই হয়ে যায় “ফলস নাইন” ফর্মেশান, আর টট্টির পজিশানটার নাম হয়ে যায় “ফলস নাইন” পজিশান।
২০০৮-০৯ মৌসুমে রুনি, তেভেজ ও রোনালদোকে ব্যবহার করে একটি স্ট্রাইকারবিহীন ফর্মেশন ব্যবহার করেছিলেন স্যার এলেক্স ফার্গুসন, কিন্তু সেখানে কোনো প্রথাগত নাম্বার নাইন ছিলো না। বরং একজন আরেকজনের সাথে পজিশন বদল করে ডিফেন্ডারদের বিভ্রান্ত করতেন। তবে ফলস নাইন পজিশনকে অমরত্ব প্রদান করা জুটির নাম পেপ গার্দিওলা ও লিওনেল মেসি, এবং তাদের শুরুটা রিয়াল মাদ্রিদকে ধ্বংস করে।
তারিখটা ১লা মে, ২০০৯। পরের দিন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এল ক্লাসিকো, পেপ গার্দিওলা স্টেডিয়ামে তাকে দেওয়া রুমে বসে রিয়াল মাদ্রিদকে কাটাছেড়া করছেন। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন, রিয়ালের তিন মিডফিল্ডার গ্যাগো, গুতি ও ড্রেন্থহে প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডকে বেশ চাপে ফেলে তাদের অবিরত প্রেস করে। অন্যদিকে দুই সেন্টার ব্যাক ক্যানাভারো ও মেটজেল্ডার এগিয়ে এসে হাইলাইন তৈরির চেয়ে নিজেদের পেনাল্টি বক্সের কাছে থাকতেই পছন্দ করেন। মিডফিল্ডার তিনজন ও সেন্টার ব্যাক দুজনের ভিন্নমুখী প্রবণতার জন্য তাদের মাঝখানে তৈরি হয় একটি বিরাট ফাঁকা স্পেস, এবং এটি খেয়াল করেই পেপ বুঝে গেলেন, কীভাবে হারাতে হবে লস ব্লাংকোসদের। রাত তখন বাজে ৯টা, পেপ ফোন করলেন মেসিকে,
“লিও,আমি পেপ। আমি মাত্রই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুমি স্টেডিয়ামে চলে আসো। এখনই, প্লিজ।”
২১ বছর বয়সী মেসি তখনই ছুটে এলেন পেপ গার্দিওলার রুমে, পেপ সেখানে তাকে সেই স্পেস দেখিয়ে বললেন, সেই জায়গাটুকুকে নিজের করে নিতে, যেন সেটিকে এখন থেকে সবাই ‘মেসি জোন’ নামে চেনে। তিনি বলেন, মেসি খেলা শুরু করবেন উইংয়েই, কিন্তু যখনই তিনি তাকে একটি ইশারা দেবেন এবং মেসি তখন সেই ফাঁকা জায়গায় সরে যাবে। এরপর জাভি বা ইনিয়েস্তা যখন তাকে পাস দেবে, তিনি চান যেন মেসি সোজা ক্যাসিয়াসের গোলের দিকে যান। এই পরিকল্পনা ছিলো সম্পূর্ণ গোপন, মেসি এবং পেপ ছাড়া কেউ কিছুই জানতো না। সহকারী টিটো ভিলানোভাকে পেপ এই পরিকল্পনা জানান পরের দিন টিম হোটেলে। ম্যাচ শুরুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে তিনি জাভি, ইনিয়েস্তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেন, তারা যেন মেসিকে মাঝখানে দেখে অবাক না হয়ে বিনাদ্বিধায় তাকে পাস দেয়। খেলার বয়স যখন দশ মিনিট, পেপ মেসিকে ইশারা করলেন, ইতো সরে গেলেন ডানে, মেসি চলে এলেন মাঝখানে। বাকিটা? ইতিহাস, রিয়াল মাদ্রিদকে তাদেরই ঘরের মাঠে ৬-২ গোলে অপমান করবার ইতিহাস।
লিওনেল মেসি এরপর এই পজিশনে ত্রাস ছড়িয়েছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। অবিশ্বাস্য ৯১ গোল তিনি করেছিলেন ২০১২ সালে এই ফলস নাইন পজিশনে খেলেই। ২০১৩ এর মাঝামাঝি থেকে ২০১৭ পর্যন্ত অবশ্য আর খেলেননি সেখানে, তবে ২০১৭ সালে আর্নেস্তো ভালভার্দে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি আবার মেসিকে খেলাচ্ছেন এই ফলস নাইন পজিশনে। যদিও সেটা আদৌ ফলস নাইনই কি না ,সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, অনেক সময়ই মনে হয় ফলস নাইনের বদলে মেসি খেলছেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে।
মেসির পর এই সময়ে ফলস নাইন পজিশনে খেলা কারো কথা বলতে হলে বলতে হবে লিভারপুলের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবার্তো ফিরমিনোর কথা। মোহাম্মদ সালাহর অবিশ্বাস্য ফর্মের কারণে ঢাকা পড়ে গেছেন, কিন্তু ফলস নাইন হিসেবে অসাধারণ খেলে ফিরমিনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন লিভারপুলের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ওঠার পথে। ফলস নাইন হিসেবে ফিরমিনো যে স্পেস তৈরি করেছিলেন, সেটি ব্যবহার করেই সালাহ হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তবে কম যাননি ফিরমিনোও।
(ছবিঃ- ফলস নাইন হিসেবে নজর কাড়ছেন ফিরমিনো)
লিগে ৩৭ ম্যাচ খেলে ফিরমিনো গোল করেছিলেন ১৫টি ,করিয়েছিলেন ৭টি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ছিলেন আরও সপ্রতিভ, ১৩ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ১০ গোল, করিয়েছিলেন ৭টি। এছাড়াও ২০১২ ইউরোজয়ী স্পেন দলে ফলস নাইন হিসেবে খেলেছিলেন সেস্ ফ্যাব্রেগাস।
কিংবদন্তি ম্যানেজার আরিগো সাচ্চি একবার বলেছিলেন, ফুটবলের পরবর্তী পরিবর্তনটা হবে পুরো মাঠটাকে মাঝমাঠ বানিয়ে। ফলস নাইন সেই কথাটিরই বাস্তব প্রতিফলন, একজন স্ট্রাইকারকে মিডফিল্ডার বানিয়ে মাঝমাঠকে আরও বড় করা। বর্তমানে সব ম্যানেজারই এমন একজন স্ট্রাইকার খোঁজ করেন, যে বিল্ড আপ প্লে-তেও ভূমিকা রাখবে, অর্থাৎ ফলস নাইনের একটি হ্রাসকৃত রূপ। হয়তো কিছু বছর পর আমরা পেছনে তাকিয়ে ভাববো,
“কী অদ্ভুত ব্যাপার, আগে এত কম দল ফলস নাইন ব্যবহার করতো!”
(সমস্ত ছবির সুত্রঃ- ইন্টারনেট)
Football Tactics for Beginners:The False 9
What is a false nine? Football tactics explained
Complete Guide to the False 9 and Who Plays It Best
What is a ‘False 9’ in Soccer? (Explained) - Soccer Coaching Pro
Forward (association football) - Wikipedia
Complete Guide to the False 9 and Who Plays It Best
‘ফলস নাইনে’র আবিষ্কার গার্দিওলারই
https://www.uvlsports.com/article/432/false-nine-leo-messi-barca-2012